হযরত আদম (আঃ) -এর খেলাফত
মহান আল্লাহ্ পাক যখন হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলেন, তখন ফেরেশতাগণকে বললেন,
"আমি জমিনের উপর আমার প্রতিনিধি বানাতে ইচ্ছা করি, যে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অধিকারী হবে। আমার জমিনের উপর যে প্রকারেই হস্তক্ষেপ করতে চাবে করতে পারবে।
নিজের প্রয়োজনীয় ব্যাপারসমুহে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী করতে পারবে, তা যেন আমার ক্ষমতার এবং আমার আধিপত্য বিস্তারের বিকাশ ক্ষেত্র হবে।"
ফেরেশতাগণ শুনে বিস্মিত ও হতবাক হয়ে আল্লাহ্ পাকের দরবারে আরয করলেন, "হে রাব্বুল আলামীন! যদি এ প্রতিনিধি সৃষ্টির হেকমত ও উদ্দেশ্য এটাই হয় যে, সে দিবা রাত্রি আপনার তসবীহ্ ও তাহলীলে মশগুল থাকবে এবং আপনার পবিত্রতা বা মহত্ত্বের গুণগান করবে, তবে এ উদ্দেশ্যের জন্য তো আমরাই যথেষ্ট।
প্রতি মুহূর্তে আপনার প্রশংসা কীর্তন করছি এবং বিনা দ্বিধায় আপনার আদেশ পালন করছি। এ মাটি দইয়ে সৃষ্ট জীব হতে কলহ - বিবাদের গন্ধ আসছে।
এমন না হয় যে, এ সৃষ্টি আপনার জমিনে ঝগড়া- ফাসাদ এবং রক্তপাত করবে। হে মা'বুদ ! আপনার এ সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য কি? "
আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে প্রথমতঃ তাদেরকে এ আদব শিক্ষা দেয়া হলো যে, " সৃষ্ট জীবকে স্রস্টার কার্যকলাপে তাড়াতাড়ি কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়।
আর স্রস্টার পক্ষ থেকে মূল তথ্য প্রকাশ করার পূর্বেই কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। তাও আবার এরূপে যে সে সন্দেহের মধ্যে নিজেদের উচ্চ মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়।
আমই সে সমস্ত বিষয় অবগত আছি যা তোমরা অবগত নও। আর আমার জ্ঞান সমুদ্রের মধ্যে এমন সব বিষয় আছে যার রহস্য কিছুই অবগত নও।"
এ সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক কুরআনে বলেন-
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَـٰٓئِكَةِ إِنِّى جَاعِلٌۭ فِى ٱلْأَرْضِ خَلِيفَةًۭ ۖ قَالُوٓا۟ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ ۖ قَالَ إِنِّىٓ أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ
উচ্চারণঃ ওয়া ইয ক্বালা রাব্বুকা লিলমালাইকাতি ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদ্বি খালিফাহ, ক্বালু আতাজআলূ ফীহা মাইউফসিদু ফীহা ওয়া ইয়াসফিকুদ দিমাআ, ওয়া নাহনু নুসাব্বিহু বিহামদিকা ওয়ানু কাদ্দিসু লাকা ক্বালা ইন্নি আ'লামু মালা তা'লামূন।
অর্থঃ আর যখন আপনার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন, "আমি জমিনে আমার প্রতিনিধি বানাতে ইচ্ছা করি।" ফেরেশতারা বলল, "আপনি কি এমন সৃষ্টিকে প্রতিনিধি বানাতে ইচ্ছা করেন, যে জমিনে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে, অথচ আমরা আপনার প্রশংশার সাথে আপনার তসবিহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং স্বীকার করছি যে, আপনার ইচ্ছা মন্দ হতে পবিত্র এবং আপনার কার্য ক্ষতি ও লোকসান হতে পবিত্র।" আল্লাহ্ পাক বললেন, "যে তথ্য ও রহস্যের প্রতি আমার লক্ষ রয়েছে সে সম্পর্কে তোমরা অবগত নও। _ সূরা বাক্বারাঃ ৩০
হযরত আদম (আ)-এর কাছে ফেরেশতাদের পরাজয়
ফেরেশতাগণ আল্লাহ্ পাকের সাথে বিতর্ক করার উদ্দেশ্যে কিংবা আল্লাহ্ পাকের কাজের খুত বের করার উদ্দেশ্যে এরূপ প্রশ্ন করেনি। বরং তাঁরা আদম (আ) কে সৃষ্টির কারণ জানতে চেয়েছিল।
আর এটাও জানতে চেয়েছিল যে, আদম (আ) কে প্রতিনিধি বানাবার মধ্যে কি হেকমত আছে?
তাঁদের আকাঙ্খা যে, হেকমতের রহস্য তাদের কাছেও প্রকাশ হােক। আল্লাহ পাক আদম (আঃ) কে নিজের সর্বাপেক্ষা উচ্চস্তরের গুণ 'ইলম' দান করলেন এবং তাকে যাবতীয় জিনিসের নাম বলে দিলেন।
অতঃপর সে সমস্ত বস্তু ও বিষয় ফেরেশতাদের সামনে পেশ করে বললেন, “তােমরা এ বস্তুগুলি সম্পর্কে কি জান?
তাদের তাে 'ইলম' জ্ঞান ছিল না, কি উত্তর দিবে । কিন্তু তারা যেহেতু আল্লাহ পাকের নিকটবর্তী ছিল বুঝতে পারল যে, “আমাদের পরীক্ষা করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা, ইতােপূর্বে এ সম্পর্কে আমাদেরকে কোন জ্ঞানই তাে দেওয়া হয় নি। কাজেই পরীক্ষা উদ্দেশ্য নয়; বরং আমাদেরকে এ বিষয়ে সতর্ক করা উদ্দেশ্য যে, আল্লাহ পাকের প্রতিনিধিত্ব করা তাসবীহ ও তাহলীল প্রভৃতি যিকির-আযকারের আধিক্যের উপর নির্ভরশীল নয়; বরং 'ইলম' নামক গুণের উপর নির্ভরশীল।
কেননা, স্বাধীন ইচ্ছা, আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা, স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি প্রয়ােগের ক্ষমতা, কিংবা অন্য কথায় এরূপ বলা যায়- যমিনের উপর শাসন পরিচালনা 'ইলম' নামক গুণ ছাড়া সম্ভব নয়। অতএব,আল্লাহ পাক আদমকে নিজের ‘ইলম’ গুণের বিকাশের পূর্ণাঙ্গ ক্ষেত্ররূপে তৈরি করলেন। অতএব,
আদম (আ) ই যমিনে আল্লাহ পাকের প্রতিনিধিত্বের উপযুক্ত আমরা নই।”
আর প্রকৃত ব্যাপার ও হল, আল্লাহ পাকের ফেরেশতাগণ যেহেতু তাঁদের উপর ন্যস্ত খেদমতসমূহ ব্যতীত সর্বপ্রকার পার্থিব আকাঙক্ষা ও প্রয়ােজন হতে পবিত্র, সুতরাং তারা ঐ সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত ছিল না । পক্ষান্তরে আদম (আ) -এর যেহেতু এ সমুদয়ের প্রয়ােজন ছিল, সুতরাং
এসবের জ্ঞান তাঁর জন্য এক স্বাভাবিক ও সৃষ্টিগত ব্যাপার ছিল, যা রাব্বুল-আলামীনের তরফ থেকে তাঁকে দান করা হয়েছে এবং তাকে সে সব কিছুই শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে যা তাঁর জন্য প্রয়ােজনীয় ছিল। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বল আলামীন কোরআনে বলেন,
وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلْأَسْمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى ٱلْمَلَـٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبِـُٔونِى بِأَسْمَآءِ هَـٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمْ صَـٰدِقِينَ-قَالُوا۟ سُبْحَـٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَآ ۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَلِيمُ ٱلْحَكِيمُ-قَالَ يَـٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئْهُم بِأَسْمَآئِهِمْ ۖ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسْمَآئِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ إِنِّىٓ أَعْلَمُ غَيْبَ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ
উচ্চারণঃ ওয়া আল্লামা আদামাল আসমায়া কুল্লাহা ছুম্মা আরাদাহুম আলাল মালাইকাতি ফাক্বালা আম্বিউনী বিআসমাই হাউলাই ইন কুনতুম ছাদিকীন। ক্বালূ সুবহানাকা লা ই্লমা লানা ইল্লামা আল্লামতানা, ইন্নাকা আনতাল আলীমুল হাকীম । ক্বালা ইয়াআদমু আম্বি’হুম বিআসমাইহিম ফালাম্মা
আম্বা আহুম বিআসমাইহিম ক্বালা আলাম আক্বুল্লাকুম ইন্নী আ'লামু গাইবাস সামাওয়াতি ওয়ালআরদ্বি
ওয়া আ'লামু মা তুবদূনা ওয়া মা কুনতুম তাকতুমূন।
অর্থঃ অতঃপর আল্লাহ পাক যা কিছু ইচ্ছা করেছিলেন তা অস্তিত্ব প্রাপ্ত হল এবং প্রকাশ পেল এবং আদম (আঃ) আল্লাহ পাকের প্রশিক্ষণে যাবতীয় জিনিসের নাম অবগত হলেন। অতঃপর আল্লাহ পাক ঐ সমুদয় জিনিসকে ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন এবং বললেন, " যদি তােমরা সত্যের উপর থাক
তবে বলে দাও, এ জিনিসগুলাের নাম কি?" ফেরেশতারা নিবেদন করলেন, "হে আল্লাহ! সমস্ত পবিত্রতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব আপনারই জন্য। আমরা তাে কেবল ততটুকুই জানি যতটুকু আপনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, প্রকৃত ইলম আপনারই এবং প্রকৃত হেকমত আপনারই ।" তখন আল্লাহ্ পাক আদেশ
করলেন, “হে আদম! এখন তুমি ফেরেশতদেরকে এসমস্ত বস্তুর নাম ও স্বরূপ বলে দাও।" যখন আদম (আঃ) ফেরেশতাদেরকে সবকিছুর নাম ও স্বরূপ বলে দিল, তখন আল্লাহ পাক বললেন, “আমি কি তােমাদেরকে বলি নি যে, আসমানসমূহ এবং যমিনের সমুদয় অদৃশ্য বস্তু আমার পরিষ্কার জানা আছে । আর তােমরা যা কিছু প্রকাশ কর তাও আমি জানি আর যা কিছু অন্তরে গােপন রাখ তাও আমি অবগত।"
-সূরা বাকারাঃ ৩১-৩৩।
হযরত আদম (আ)-কে যে ইলম দান করা হয়েছিল সে সম্পর্কে মুফাসসিরগণ দুইধরনের মত পােষণ করেছেনঃ
এক প্রকার মত হল, বিশ্বজগতের যাবতীয় বস্তু যা অতীতকাল হতে ভবিষ্যৎ কাল পর্যন্ত অস্তিত্ব প্রাপ্ত হয়েছে, হচ্ছে বা হবে, সে সমূদয়ের নাম এবং তাদের মূল তথ্যের জ্ঞান আদম (আ)-কে দান করা হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকারের মত হল, সে সময়ে যে পরিমাণ বস্তুই জগতে বিদ্যমান ছিল এবং হযরত আদম (আঃ)-এর সামনে উপস্থাপিত করা হয়েছিল, সে সমূদয় বস্তুু সম্পর্কে তাকে শিক্ষা দান করা হয়েছিল আর সকল বস্তুর নাম যেমন জগতের আদি হতে অন্ত পর্যন্ত সকল বস্তু সম্পর্কে বলা যেতে পারে তদ্রুপ সে সময়কার বস্তু সম্পর্কেও বলা যেতে পারে কোন প্রকারের ব্যাখা ব্যতীত। আর এটাও হতে পারে যে, কথা নিয়ে অধিকাংশ সময়ে অস্তিত্বশীল অনুভবনীয় অর্থাৎ উপস্থিত বস্তুসমূহের প্রতি ইঙ্গিত করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। আর যদি এরুপ বলা হয় যে, আয়াতটির অর্থ এ নয় যে, বিস্তারিতভাবে বস্তু সমূহের সমস্ত সংখ্যার ইলম দান করা হয়েছিল। বরং বস্তু সমূহের মূল ও ভিত্তি জ্ঞান দান করা হয়েছিল তবু সমস্ত বস্তুর নাম কথাটির বিরোধী হয় না। । হযরত আদম (আ)-কে 'ইলম' গুণে এরুপে গুণান্বত করা হয়েছিল যে, ফেরেশতাদের পক্ষেও তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং খেলাফতের যোগ্যতা স্বীকার না করার উপায় থাকলো না এবং একথা মানতেই হলো যে, যদি আমাদেরকে যমিনে আল্লাহর প্রতিনিধি বানানো হত, তবে সৃষ্ট জগতের যাবতীয় বহস হতে অজ্ঞ থাকতাম। আর আল্লাহ পাক অদম (আ)-কে যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞান দান করেছেন সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজানা থাকতাম। কেননা, আমাদের পানাহারেরও প্রয়ােজন হয় না যে, সে জন্যে আমরা যমিনের মধ্যে নিহিত খাদ্য-দ্রব্যাদি ও ধন-ভাণ্ডারের অন্বেষণ করতাম। আমাদের পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার আশংকাও নেই যে, সে জন্যে নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ করতাম। আমাদের রোগ-ব্যাধির আশংকাও নেই যে, যার জন্য বিভিন্ন রকমের ঔষধ জাতীয় বস্তুর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, রাসায়নিক সযুক্ত পদার্থ, স্বভাবজাত এবং আসমানী বস্তুসমূহের উপকারিতা, চিকিৎসা শাস্ত্রের আবিষ্কার, শরীরের প্রতি ও অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান এবং এ প্রকারের মূল্যবান অসংখ্য বিদ্যা ও বিষয়ের রহস্যাবলি এবং হেকমত সম্পর্কে জানতে পারতাম। নিঃসন্দেহে, এটা শুধু মানুষের জন্য উপযোগী ছিল। কেননা, সে এটা দিয়ে যমিনে আল্লাহ পাকের খলীফা হবে এবং ঐ সমস্ত রহস্যাবলি, পরিচয় জ্ঞান, বিদ্যা ও বিষয়সমূহ সম্পর্কে অবহিত হয়ে আল্লাহ্ পাকের প্রতিনিধিত্বের সঠিক হক আদায় করবে।
0 মন্তব্যসমূহ