পৃথিবীর প্রথম মানুষ
হজরত আদম (আ) সম্পর্কে কুরআন - এ যে সকল তথ্য বর্ণনা করা হয়েছে, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে একথাটি পরিষ্কার হওয়া দরকার যে মানুষ অস্তিত্বের জগতে আগমন বিষয়ে আলোচনাটিতে বর্তমান কালের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যা "ক্রমোন্নতি" নামে খ্যাত |
এ 'ক্রমোন্নতির' দাবী হলো বর্তমানে মানবজাতি আদিকাল থেকেই মানুষ রূপে সৃষ্টি হয়েছে; বরং এ অস্তিত্বের জগতে সে বহু ধাপ ও স্তর অতিক্রম করে বর্তমানের এ মানবাকৃতিতে পৌঁছেছে |
পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের মতে প্রাণিজগৎ প্রথমে নির্জীব পদার্থ এবং পরে উদ্ভিদ জাতীয় বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে অনেক সময় পরে ধাপে ধাপে উন্নতি করতে করতে প্রথমে জোকের রূপ ধারণ করে |
তারপর এরূপে প্রাণী জাতীয় ছোট-বড় বিভিন্ন প্রাণীর আকার ধারণ করতে করতে অবশেষে মানুষের আকৃতি রূপান্তরিত হয়েছে |
এ বিষয়ে ধর্মের কথা হল সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা মহান আল্লাহ পাক আদি মানবকে আদম (আ) এর আকৃতি সৃষ্টি করেছেন | তারপর তারই অনুরূপ স্বজাতি হজরত হাওয়া (আ) -কে এনে ধারাবাহিকভাবে মানব জাতির বংশ সূচনা করেছেন | আর এ আদম সন্তানই সে মানুষ, মহান আল্লাহ পাক যাকে সকল সৃষ্টির উপর দান করেছেন |
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শরীয়তরুপী গুরুভার আমানতের বোঝা তার উপর ন্যাস্ত করেছেন এবং সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে তার অনুগত করে দিয়ে আল্লাহ পাকের প্রতিনিধিত্বের মহা দান করেছেন |
আল্লাহ পাক এ বিষয়ে কুরআনে ঘোষণা করেছেন যে -
- لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ -
উচ্চারণ : লাক্বদ্ খলাকনাল্ ইন্সা-না ফী আহ্সানি তাক্বওয়ীম্।
- সূরা আত-তিন : ৪
অর্থ : আল্লাহ তা'আলা বলেন নিঃসন্দেহে আমি মানুষকে অতি উত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি |
আল্লাহ তা'আলা আরও বলেন, "আর নিঃসন্দেহে আমি আদম সন্তানদেরকে সকল সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি|"
সূরা বাকারায় আল্লাহ তা'আলা বলেন,
- اِنِّىۡ جَاعِلٌ فِى الۡاَرۡضِ خَلِيۡفةً
উচ্চারণ : ইন্নী জাঈলুন ফিল আরদি খালিফা ।
- সূরা বাকারা ঃ ৩০
অর্থ ঃ আমি আদমকে পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই .
আল্লাহ তাআলা অনত্র বলেছেন, আমি আমার আমানতের বোঝাকে আমার আসমানসমূহ, পৃথিবী এবং পর্বতমালার সামনে পেশ করলাম . কিন্তু তারা সকলেই আল্লাহ পাকের সে আমানতের বোঝা বহন করতে অক্ষমতা প্রকাশ করল এবং উক্ত বোঝা বহন করতে ভয় পেল . অথচ মানুষের সে আমানতের বোঝা মাথায় তুলে নেয় |
-সূরা আহযাব : ৭২
এখানে আলোচ্য বিষয় হলো, 'ক্রমোন্নতি' ও ধর্মীয় মতবাদদয়ের মাঝে মূলেই জ্ঞানগত বিরোধ ছিল, নাকি এদের মাঝে সামঞ্জস্য কোন সম্ভাবনা আছে | বিশেষ করে যখন বিবেক ও অভিজ্ঞতা থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, ধর্মীয় তথ্যাদিএবং বিবেকের মাঝে কোথাও বিরোধ নেই | অন্ততপক্ষে কোন স্থানে যদিও দেখা যায় তবে বুঝতে হবে বিবেক সম্মত কোন কোন তথ্য গোপন থাকার কারণে এরূপ হয়েছে |কেননা, বহুবার এভাবে দেখা গেছে যে, বিবেক সম্মত গোপন তথ্য যখনই বিবেকের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তখনই সে বিরোধ ও দূর হয়েছে এবং সে তথ্যই বিবেকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যা
আল্লাহপাকের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে |
অথবা বিষয়টিকে এভাবে বলা যায় যে, বিবেক ও ধর্মের মাঝে কোন সময় বিরোধ হলে পরিলক্ষিত
বিবেককে তার স্থান ত্যাগ করতে হয় এবং আল্লাহ পাকের ওহীর মীমাংসাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয় ।অতএব এক্ষেত্রেও এমনিতে এ প্রশ্ন সামনে এসে পড়ে যে, আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ 'ক্রমোন্নতি'র ব্যাপারে প্রকৃত অবস্থা কি এবং এর রূপ কি?
এর উত্তরে বলা যায় যে, এক্ষেত্রেও বিবেকসম্মত ক্রমোন্নতি এবং ধর্মীয় মতবাদের মাঝে বিরোধ দেখা যায় না । অবশ্য এ বিষয়টি যেহেতু সূক্ষদর্শীতার বিষয়, সেহেতু এখানে ওটা বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয় ।
তবুও এখানে তথ্যটি অবশ্যই সামনে রাখা প্রয়োজন যে, বর্তমান মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ) ক্রমোন্নতি-মতবাদ অনুযায়ী ধাপে ধাপে উন্নতি করেই মনুস্মৃতি পর্যন্ত পৌঁছে থাকুক কিংবা প্রথম সৃষ্টি লগ্ন মানুষের আকৃতি অস্তিত্ব লাভ করে থাকুক, বিবেক ও ধর্ম উভয়ই এই কথায় একমত যে, বর্তমানে এ মানবজাতিই সৃষ্টির মাঝে সেরা সৃষ্টি এবং জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন এ আকৃতিকেই নিজের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে জবাবদিহি করতে হবে এবং এরাই আল্লাহপাকের নির্ধারিত আইন কানুনে অভ্যস্ত ।
আবার এভাবে বলা যেতে পারে যে, মানুষের কার্যকলাপ এবং তার ইলম-আমল ও চরিত্র বিষয় গতিবিধির পরিপ্রেক্ষিতে এ কথার কোন গুরুত্ব নেই যে, তার সৃষ্টি এবং অস্তিত্ব প্রাপ্তির ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন কি ? বরং গুরুত্বের বিষয় হচ্ছে এ সৃষ্ট জগতে তার অস্তিত্ব এমনই নিরর্থক এবং উদ্দেশ্যবিহীনভাবেই এসেছে, না তার অস্তিত্ব নিজের মাঝে কোন মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে তার কার্যাবলী এবং উক্তিসমূহের ফলাফল কি একেবারেই অর্থহীন ? তার জড় দেহের ও আধ্যাত্মিক মর্যাদাসমূহ সবই কি নিষ্ফল, না মূল্যবান প্রতিফলের অধিকারী এবং তাৎপর্যের দায়িত্ব রাখে ? আর তার জীবন কি নিজের মাঝে উজ্জল ও দীপ্তিমান বহন করছে ? না কি কোন অন্ধকার ও তমসাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিংবা তার অতীত ও বর্তমান তার ভবিষ্যৎ হতে বঞ্চিত হচ্ছে ?
এসকল তথ্যানুসন্ধানের উত্তর যদি নেতিবাচক না হয়ে ইতিবাচক হয়, তবে স্বতঃপূর্ত একথা মেনে নিতেই হবে যে তার সৃষ্টি অবস্থা সম্পর্কে আলোচনার পরিবর্তে তার অস্তিত্ব জগতের আগমনের উদ্দেশ্যর প্রতি বিশেষভাবে নজর দেয়া উচিত এবং একথা মেনে নিতেই হবে যে, সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির অস্তিত্বপ্রাপ্তির পিছনে এক মহান উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে ।
এ কারণেই কোরআন মাজীদ মানবজাতি সংক্রান্ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকের স্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে মানবজাতির অস্তিত্বের ঘোষণা করেছে এবং বলেছে বিশ্বের সকল সৃষ্টির স্রষ্টার সৃষ্টির মাঝে মানব আকৃতি সৃষ্টি সর্বদাই সুন্দর সৃষ্টি । এ কারণেই মানুষ সৃষ্টির তুলনায় অধিক সম্মান ও মহত্বের অধিকারী । আর তার সুন্দর গঠন ও সম্মানিত হওয়ার কারণে নিঃসন্দেহে সে আল্লাহপাকের আমানতের বোঝা বহনকারী হয়ে আল্লাহপাকের প্রতিনিধিত্বের পদে অধিষ্ঠিত থাকার যোগ্য ।
আর যখন এ সমস্ত কিছু তার মধ্যে নিহিত রয়েছে, তখন তার অস্তিত্বকে নিষ্ফল উদ্দেশ্যবিহীন বাদ দেওয়া কিভাবে সম্ভব হতে পারে ?
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন -
أياهاسابول إنسانو يوتوراكا سودا
উচ্চারণ ঃ আইয়াহসাবুল ইনসানু আইউতরাকা সুদা।
অর্থঃ মানুষ কি এরূপ ধারণ করে নিয়েছে যে, তাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ত্যাগ করা হবে ?
বিবেক ও বুদ্ধি বিশিষ্ট এই আকৃতিকে সমগ্র সৃষ্ট জগতের সেরা বানিয়ে তাকে ভাল-মন্দের পার্থক্যকরণ শক্তি দান করা হয় এবং মন্দ থেকে দূরে থাকা এবং ভারকে অবলম্ব করার মানষে তৈরি করা হয় ।
এ বিষয়ে আল্লাহ পাক কুরআনে বলেন -
خالاكاهو تشوما هادا فا هيناهول نا زادين
উচ্চারণ ঃ খালাকাহু ছুম্মা হাদা ফা হাহাইনাহুল না জাদাইন ।
অর্থঃ অনন্তর আমি মানুশকে ভাল ও মন্দের উভয় পথ প্রদর্শন করেছি ।
মোটকথা, কোরআন মাজীদের আহবান,আদেশ ও নিষেধ ও হেদায়েত ও পথ প্রদর্শনের লক্ষ্যস্তল এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কেন্দ্রস্তল এ অস্তিত্বই বটে যাকে মানুষ নামে মূল্যায়ন করা হয় ।
এ কারনেই কোরআন মাজীদ প্রথম মানবের স্রিস্তের অবস্থা ও বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে তার দুনিয়া ও আখিরাতের বিধানসমূহের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য ঃ উল্লিখিত অংশের অধিকাংশই "মাওলানা ক্বারী মোহাম্মাদ হাসান " - এর "কোরআন হাদিসের আলোকে কাসাসুল আম্বিয়া" - বইটির থেকে সংগৃহীত করা হয়েছে ।"
ধন্যবাদ।
0 মন্তব্যসমূহ